আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (Fifty years of politics as I saw it)
লেখক: আবুল
মনসুর
আহমদ
ধরন:
রাজনৈতিক
ইতিহাস
(আত্মজীবনীমূলক)
প্রকাশনী:
খোশরোজ
কিতাব
মহল
প্রথম
প্রকাশ:
১৯৬৮
মুদ্রিত
মূল্য:
৬০০
টাকা
(অনলাইনে
পিডিএফ
সহজলভ্য)
পৃষ্ঠা:
৬৮১
- রিভিউ:
লেখককে পুরোদস্তুর একজন রাজনীতিবিদ বলা যায়। আওয়ামী লীগের প্রথম সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তিনি, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ফজলুল হক মন্ত্রিসভার প্রাদেশিক স্বাস্থ্যমন্ত্রী, আবার ১৯৫৬ সালে সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, জওহরলাল নেহেরু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে ছিল তাঁর গভীর হৃদ্যতার সম্পর্ক। সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল 'তুমি তুমি' পর্যায়ের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব লেখককে লিডার বলে সম্বোধন করতেন।
রাজনীতিবিদরাও যে বিশ্ব কাঁপানো লেখক হতে পারেন, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইস্টান চার্চিল, যিনি কিনা একদম নোবেল পেয়ে গেলেন। আবুল মনসুর আহমদও রাজনীতি করেছেন, সাথে নিজের কলমকেও সচল রেখেছেন। আয়না, ফুড কনফারেন্স, গালিভারের সফর নামা, বেশি দামে কেনা কম দামে বেঁচে আমাদের স্বাধীনতা, শেরে বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু এমন অনেক গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। তাঁর লেখনীর জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন, আরও ছোট বড় অসংখ্য স্বীকৃতি তো আছেই। যদিও পুরস্কারের সংখ্যা দিয়ে একজনের যোগ্যতা মাপাই করা যায় না।
সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তিনি বিস্ময়কর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রায় অর্ধডজন পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন।অনেক বিখ্যাত সাংবাদিক, সম্পাদকের গুরু ও প্রশিক্ষণদাতা ছিলেন তিনি। যে অঙ্গনেই তিনি কাজ করেছেন, সেখানেই শীর্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
আচ্ছা এবার তাহলে বইয়ে কী আছে, সেটা দেখা যাক। মোট ৬৮১ পৃষ্ঠার বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে, যেখানে ৩০টি অধ্যায় ছিল। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশের প্রেক্ষিতে উপাধ্যায় নাম দিয়ে আরো ১০ টি অধ্যায় যোগ করা হয় বইটির তৃতীয় সংস্করণে, ১৯৭৩ সালে।
স্মৃতিকথার আঙ্গিকে লেখা এই বইটিতে লেখক ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে পুরো পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়-পরবর্তী সময় পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাব্দীর রাজনৈতিক ইতিহাস অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন।
প্রথম অধ্যায়কে লেখক তাঁর 'রাজনীতির ক খ' নাম দিয়েছেন। তাঁর মধ্যে কীভাবে রাজনৈতিক সচেতনতা ও ইংরেজ বিরোধী মনোভাব গড়ে উঠে সেটা উল্লেখ করেছেন।
খিলাফত আন্দোলন, খিলাফতের অবসান, অসহযোগ আন্দোলন, বেঙ্গল প্যাক্ট, প্রজা আন্দোলনের কথা উঠে এসেছে এই বইয়ে।
উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িকতার বহুরুপ ফুটে উঠেছে বইটিতে। সমাজের পদে পদে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিরোধ আর অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল; পান থেকে চুন খসলেই দাঙ্গা বেঁধে যাওয়ার মত অবস্থা হত।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু আর মহাত্মা গান্ধী দুই জনের স্বাধীনতা লাভের চিন্তা ভিন্ন হলেও রাজনীতির সাথে তাদের কত গভীর দেশপ্রেম ছিল, সেটাও উঠে এসেছে এ বইয়ে।
ধর্মই যে তৎকালীন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত এবং দেশভাগের মূলে রয়েছে ধর্মের সংঘাত; বিষয়টি প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। দ্বিজাতি তত্ত্ব, লাহোর প্রস্তাব, কলকাতা দাঙ্গা, দেশভাগের আদ্যোপান্ত জানা যাবে এই বইয়ের মাধ্যমে। বিশেষ করে দেশ ভাগ নিয়ে আমাদের যে ভাসা ভাসা ধারণা রয়েছে, এবার একটি পরিপূর্ণ ধারণা হবে।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং ফজলুল হক সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানি, বইটি পড়ে নতুন আরও অনেক কিছু জানা যাবে। বাংলার রাজনীতি তাদের কাছে কতটা ঋণী, তাও অনুধাবন করা যাবে। লেখক একবার ফজলুল হককে বললেন: "অন্যায় না করলে মিথ্যা বদনাম কেউ দিতে পারে না। কই আমার বদনাম তো কেউ করে না।" বাংলার বাঘ জবাব দিয়েছিলেন: "আম গাছেই লোকে ঢিল মারে। শেওড়া গাছে কেউ মারে না। ফজলী আমের গাছে আরও বেশি মারে।"
দেশভাগের পর শুরু হয় পাকিস্তান আমল। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা, ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, দুই পাকিস্তান বৈষম্য, ছয় দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুথান, ৭০ এর নির্বাচন, ৭ মার্চ একে একে বর্ণনা করেছেন। ৭ মার্চ নিয়ে তো আমাদের অনেক আগ্রহ, ৭ মার্চের দিনের শুরুটা কেমন ছিল এবং বঙ্গবন্ধু কতটা প্রেশার নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলেন সেটা আঁচ করা যাবে। শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে অনেক তথ্য মিলবে এই বইয়ে। লেখকের সাথে বঙ্গবন্ধুর অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল, বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময়ে পরামর্শ নিতেন।
বইয়ের শেষ দিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি বিশ্লেষণ রয়েছে, সেটি অসাধারণ। মুজিব বিহীন মুজিবনগর সরকার কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ সামাল দিল, তা জানা যাবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের মুজিব শাসনামলের কিছু বিষয় সম্পর্কেও জানা যাবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর বাংলাদেশ ত্যাগ, মৈত্রী চুক্তি, বাংলাদেশের সংবিধান রচনা ইত্যাদি।
মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নিয়ে লেখক নিজের একটি অভিমত প্রকাশ করেছেন। বইটি শেষ হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন এবং উপমহাদেশীয় ঐক্যজোটের সম্ভাবনার কথা দিয়ে। বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতি শুভকামনা ছিল লেখকের।
- পাঠ
প্রতিক্রিয়া:
বইটি আমি দুই বছর আগেই পড়েছিলাম, পিডিএফ কপি। এরপর এইবারের বইমেলায় (২০২০) আমি বইটির হার্ডকপি সংগ্রহ করি। কেন সংগ্রহ করেছি? এমন একটি বই বুক শেলফে থাকা উচিত, অন্তত সাজিয়ে রাখার জন্য হলেও!
- আপনি
কেন
বইটি
পড়বেন:
আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর নতুন প্রজন্মের জন্য একটি জীবন্ত ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের ২৩ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঢাকায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “বাংলার মানুষ বিশেষ করে ছাত্র এবং তরুণ সম্প্রদায়কে আমাদের ইতিহাস এবং অতীত জানতে হবে। বাংলার যে ছেলে তার অতীত বংশধরদের জানতে পারে না, সে ছেলে সত্যিকারের বাঙালি হতে পারবে না।”
করোনা মহামারির এই ঘরবন্দি সময়ে বইটির হার্ডকপি যদি আপনার সংগ্রহে না থাকে, আর আপনি যদি পিডিএফ পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, তাহলে অনলাইন থেকে পিডিএফ নামিয়ে পড়ে ফেলতে পারেন। সুন্দর মানুষ হওয়ার জন্য পূর্ব পুরুষদের ইতিহাস জানা থাকা চাই!
0 Comments